...

ভারত কবে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে?

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪-এ ভারতের কাছে একটি কূটনৈতিক নোট পাঠিয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানিয়েছেন যে দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে তারা 'একটি প্রত্যর্পণের অনুরোধ সংক্রান্ত' নোট ভার্বাল হাতে পেয়েছে

তবে, মি. জয়সওয়াল এটাও জানিয়েছেন যে তারা এ বিষয়ে এখনই কোনও মন্তব্য করবেন না।

বিবিসিসহ প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে যেসব আলোচনা ও বিশ্লেষণ উঠে এসেছে তাতে এটাই স্পষ্ট যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেশে একের পর এক মামলা হলেও এই চুক্তির আওতায় তাকে ফেরানো যাবে না। এ বিষয়ে বিবিসি-র একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের চুম্বক অংশ নিচে তুলে ধরা হলঃ

বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নিজ দেশে একের পর এক মামলা হলেও এই চুক্তির আওতায় তাকে ফেরানো যাবে – সেই সম্ভাবনা কার্যত নেই বলেই মনে করছেন দিল্লির পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা।

প্রত্যর্পণ চুক্তিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা আছে – আর সেটা হল - যার হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগটা যদি ‘রাজনৈতিক প্রকৃতি’র হয় তাহলে সেই অনুরোধ খারিজ করা যাবে।

নানা আইনি জটিলতা বা মারপ্যাঁচ দেখিয়েও সেই অনুরোধ ফেলে রাখতে পারে দিনের পর দিন।

সবচেয়ে বড় কথা – শেখ হাসিনা বিগত প্রায় ৫০ বছর ধরে ভারতের সবচেয়ে আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত বন্ধুদের একজন।

ফলে তাকে বিচারের জন্য বা দন্ডিত হলে শাস্তিভোগের জন্য বাংলাদেশের হাতে ভারত তুলে দেবে – বাস্তবে এই সম্ভাবনা কার্যত নেই বললেই চলে।

এই পদক্ষেপের জন্য হাজারটা যুক্তি বের করাও কোনও কঠিন কাজ নয়। 

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যে সব মামলা দায়ের হয়েছে, তার কোনওটিতে যদি আদালত ‘ফেরার’ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেয়, তাহলেও “অভিযোগগুলো শুধুমাত্র ন্যায় বিচারের স্বার্থে, সরল বিশ্বাসে আনা হয়নি” – বলে সেটি নাকচ করার ক্ষমতা ভারতের থাকবে।

অভিযোগগুলো যদি ‘সামরিক অপরাধে’র হয় – যা সাধারণ ফৌজদারি আইনের পরিধিতে পড়ে না – তাহলেও একইভাবে অনুরোধ নাকচ করা যাবে।

স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্কট্যাঙ্ক আইডিএসএ-র সিনিয়র ফেলো স্ম্রুতি পট্টনায়ক বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, আদালতে তোলার সময় সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিকে যেভাবে কিল-ঘুষি মারা হল, কিংবা তার আগে সাবেক শিল্প উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বা সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে আদালতে হেনস্থা হতে হল – তাহলে বিচারের জন্য বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়া হলে - শেখ হাসিনারও যে একই পরিণতি হবে না, এই নিশ্চয়তা কে দেবেন?”

 এই সব ঘটনার দৃষ্টান্ত দিয়ে ভারত অনায়াসেই বলতে পারবে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সঠিক ও সুষ্ঠু বিচার পাবেন বলে তারা মনে করছে না এবং সে কারণেই তাকে হস্তান্তর করা সম্ভব নয়।

অর্থাৎ “অভিযোগগুলো শুধুমাত্র ন্যায় বিচারের স্বার্থে, সরল বিশ্বাসে আনা হয়নি” – এই ধারাটি ব্যবহার করেই তখন প্রত্যর্পণের অনুরোধ নাকচ করা যাবে বলে দিল্লিতে অনেক পর্যবেক্ষকের অভিমত।

ভারতে আর একদল বিশ্লেষক মনে করেন, শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর করার অনুরোধ সরাসরি নাকচ না-করেও দিল্লি দিনের পর দিন তা ঝুলিয়েও রেখে দিতে পারে।

ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ টিসিএ রাঘবন সোজাসুজি বলছেন, বিপদের মুহুর্তে শেখ হাসিনাকে ভারত যেভাবে আশ্রয় দিয়েছে সেটাই ভারতের নীতি – তাকে ‘আরও বড় বিপদে ফেলা’টা ভারতের জন্য কোনও ‘অপশন’ হতেই পারে না!

তার জন্য যে কোনও ‘উপায়’ বা যে কোনও ‘যুক্তি’ খুঁজে বের করাটাও তেমন কোনও সমস্যা নয় বলে মনে করেন তিনি।

“একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনার পাশে এখন যদি আমরা না দাঁড়াই, তাহলে বিশ্বের কোথাও আর কোনও বন্ধু দেশের নেতা ভারতকে বিশ্বাস করতে পারবেন না, ভারতের ওপর আস্থা রাখতে পারবেন না”, বলছেন মি. রাঘবন।

আর এই ‘পাশে দাঁড়ানোর’ই একটা রাস্তা হতে পারে - শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের অনুরোধ অনির্দিষ্টকালের জন্য অনিশ্চিত করে তোলা।

কারণ, এই ধরনের সব চুক্তিতেই নানা ‘লুপহোল’ বা ‘ফাঁকফোকর’ থাকে – যেগুলো কাজে লাগিয়ে আইনি বিশেষজ্ঞরা কয়েক মাস বা কয়েক বছর পর্যন্ত একটা অনুরোধকে স্থগিত করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।

শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও ভারতও একই ধরনের পথ নেবে বলে বহু বিশ্লেষক নিশ্চিত।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও ঢাকায় ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এই ধরনের চুক্তির আওতায় অনুরোধ মঞ্জুর হতে এমনিতেও অনেক সময় বছরের পর বছর লেগে যায়।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, “মুম্বাইয়ে ২৬/১১র জঙ্গি হামলার ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত তাহাউর হুসেন রানা – যিনি একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত মার্কিন নাগরিক – তাকে হাতে পাওয়ার জন্য ভারত চেষ্টা চালাচ্ছে সেই ২০০৮ সাল থেকে।”

“এখন ধরুন, ভারত ও আমেরিকার মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে কিন্তু সেই ১৯৯৭ সাল থেকে। অন্য বহু দেশেরও আগে আমেরিকার সঙ্গে ভারত এই চুক্তি করেছে – ফলে এতদিনে তাকে তো ভারতের হাতে পেয়ে যাওয়াই উচিত ছিল, তাই না?”

“কিন্তু আমরা সবে গত সপ্তাহে (১৫ই অগাস্ট) দেখলাম ক্যালিফোর্নিয়ার একটি আদালত রায় দিয়েছে, রানাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া যাবে। ইতিমধ্যেই প্রায় ১৬ বছর কেটে গেছে, এখন দেখুন হাতে পেতে আরও কত সময় লাগে”, বলছিলেন মি. চক্রবর্তী।

ফলে শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের জন্য ভারতের কাছে কোনও অনুরোধ এলে সেটা যে কয়েক দিন বা কয়েক মাসের মধ্যেই নিষ্পত্তি হয়ে যাবে – তা মনে করার কোনও কারণ নেই।

 

Share this post: