
...
উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে বাংলাদেশ
২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এক ক্যু’র মাধ্যমে বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন।তখন ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ শিরোনামে কবি শামসুর রাহমান-এর একটি কাব্যগ্রন্থ বাংলাদেশে আলোড়ন তোলে। ওই গ্রন্থে একই শিরোনামে একটি কবিতাও রয়েছে। কবিতাটির পটভূমি সম্পর্কে ৪ মে ২০১৬ সালে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় এক নিবন্ধে গবেষক মুনতাসির মামুন লিখেন-
“এরশাদ আমলে যখন ধর্ম নিয়ে ভন্ডামি চূড়ান্ত পর্যায়ে চলছে তখন খবর ছাপা হলো, কয়েকটি উট আনা হয়েছে ঢাকায়। এবং বেশ কিছু ব্যক্তি উটের মূত্র সংগ্রহ করছে পবিত্র পানীয় হিসেবে পান করার জন্য। যেমন আমরা হজে গেলে জমজমের পানি নিয়ে আসি। তারপর পবিত্র পানীয় হিসেবে অল্প অল্প করে খাই যেন ফুরিয়ে না যায়। তখন শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। এই কালজয়ী কবিতার কয়েকটি লাইন তুলে ধরলেই বুঝা যায় এটি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতেও কতখানি প্রাসঙ্গিক। -
“ভোরবেলা ঘন
কুয়াশার তাঁবুতে আচ্ছন্ন চোখ কিছুটা আটকে গেলে তার
মনে হয় যেন উঠেছে জেগে সুদূর বিদেশে
যেখানে এখন কেউ কারো চেনা নয়, কেউ কারো
ভাষা ব্যবহার আদৌ বোঝে না; দেখে সে
উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ,
হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায় বৃথা যায়।”
প্রফেসর ইউনুসের তথাকথিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাত্র আট মাসের মাথায় বাংলাদেশের মানুষের বিশ্ব-স্বীকৃত দুটি অর্জন যা দেশের স্বাধীনতা এবং হাজার বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তেই বাতিল করা হলো।
১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ- যে দিনটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, ইউনুস সেদিনটি জাতীয় দিবসের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। অথচ সেদিনের ঐতিহাসিক ভাষণটি পাকিস্তানের নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার জাতীয় সংগ্রামের জন্য একটি শক্তিশালী প্রেরণা হিসাবে চিহ্নিত। এজন্য এই ভাষণ স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালিদের ‘ম্যাগনা কার্টা’ হিসাবে গণ্য করা হয়। ২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণের গুরুত্ব স্বীকার করে একে ‘মেমরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্ত করে, যা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসম্পদের সংরক্ষণের একটি সম্মানজনক তালিকা।
এবার নাম বদলের নামে বাদ দেয়া হলো বাংলা নববর্ষ উদযাপনের আইকনিক অনুষ্ঠান 'মঙ্গল শোভাযাত্রা’। শেখ হাসিনার সরকারের সময় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১৬ সালের ৩০শে নবেম্বর ইউনেস্কো ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকা “Intengible Cultural Heritage-এ অন্তর্ভুক্ত করে। ইউনুস সেটিও বদলে দিলেন। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানিদের মতো তিনিও ‘মঙ্গল’ শব্দে ‘হিন্দুত্বের’ গন্ধ পেলেন।মঙ্গল শোভাযাত্রা হলো আনন্দ শোভাযাত্রা- আরেকটি রিসেট। তাহলে মঙ্গলবার কি আনন্দবার হবে? এবং এমন হাজারো ‘হিন্দুয়ানী’ শব্দের প্রতিস্থাপনের রিসেট বাটন কবে টিপবেন? আশার কথা, এজন্য মনে হয় না জাতিকে বেশী দিন অপেক্ষা করতে হবে। কারণ ইউনুস যা করছেন ও করবেন সে সবকে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদীরা ‘ভেস্টেড ইন্টারেস্ট’ বলে খাটো করে দেখতে চাইলেও ইউনুস জানেন তার মিশন ভেস্টেড ইন্টারেস্ট-এর পরিধির চেয়ে অনেক বড়। সংক্ষেপে তা হচ্ছে রিসেট বাটন টিপে একটি জাতিসত্ত্বা বিলুপ্ত করা। আর তা করতে হলে সবার আগে সেই জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ধংস করাই হচ্ছে প্রধান ও কার্যকর অস্ত্র। কারণ একটি জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার ফল হয় গভীর এবং সুদূরপ্রসারী। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য—যা মূর্ত, যেমন স্মৃতিস্তম্ভ ও নিদর্শন, অথবা বিমূর্ত, যেমন ঐতিহ্য এবং ভাষা—একটি জাতির অতীত বুঝতে এবং তার ভবিষ্যত গঠন করতে সাহায্য করে।কিন্তু যদি এসব ধ্বংস করা যায় তাহলে বর্তমান জনগোষ্ঠীকে তাদের শিকড় এবং পরিচয়ের সাথে সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সহজে তাদের দুর্বল, মনোবলহীন ও অস্থিতিশীল করা যায়। একইভাবে সঠিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে বঞ্চিত এমন একটি ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ে ওঠে যাদের ইউনুসের মতো লোকেরা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ায় হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।
যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডস-এর গবেষক নিকোল উইনচেস্টার “Targeting culture: The destruction of cultural heritage in conflict” নিবন্ধে লিখেছেন যে এই ধ্বংস প্রায়শই দ্বন্দ্বের সময় উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘটানো হয়। যেমন তালেবানরা ২০০১ সালে বামিয়ানের বুদ্ধ মূর্তিগুলি ধ্বংস করেছে এবং আইএসআইএস সিরিয়ায় সাংস্কৃতিক স্থানগুলিকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। একই পথে একই উদ্দ্যেশে অগ্রসর হচ্ছেন ইউনুস ও তার সহযোগিরা।
আওয়ামী লীগের সময়েও একবার বাংলা নববর্ষ উদযাপন বন্ধে মৌল্বাদিরা ফতোয়া দিয়েছিলো, যা আমলে নেয়া হয়নি। কিন্তু ইউনুস নিজেই এখন তা করছেন এবং দাবি করছেন তিনি রিসেট করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে মুনতাসির মামুনের উল্লিখিত নিবন্ধ থেকেই আরেকটি উদ্ধৃতি দেয়া যায়-“হ্যান্স এ্যান্ডারসেনের গল্পে আছে, রাজা উলঙ্গ হয়ে চলছেন কিন্তু তার ধারণা পরনে তার জাঁকালো পোশাক। আর শিশুরা তা দেখে হাসি-তামাশা করছে।”
ইউনুসের অবস্থা হয়েছে তাই। বাংলাদেশকে সার্বিকভাবেই ধবংসের দিকে ঠেলে দিয়ে তিনি দাবি করছেন, দেশ এগুচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে কোন দিকে? ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের দিকে যে নয়, তা খুবই স্পষ্ট। তাই শামসুর রাহমান-এর আরকেটি কবিতার কয়েকটি লাইন আজকের বাংলাদেশের পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেছে। চারপাশের অসহনীয় অবস্থায় নিজের ক্ষোভ দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে কাব্যগ্রন্থের ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ কবিতায় শামসুর রাহমান ব্যক্ত করেছেন এভাবে –
হে পাক পরোয়ার দেগার, হে বিশ্বপালক
আপনি আমাকে লহমায়
একজন তুখোড় রাজাকার করে দিন। তা হলেই আমি
দীনের নামে দিনের পর দিন তেলা মাথায়
তেল ঢালতে পারবো অবিচল।
গরীবের গরিবী কায়েম রাখবো চিরদিন আর
মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের চামড়া দিয়ে
ডুগডুগি বানিয়ে নেচে বেড়াবো দিগ্বিদিক আর সবার নাকের তলায়
একনিষ্ঠ ঘুণপোকার মতো অহর্নিশ
কুরে কুরে খাবো রাষ্ট্রের কাঠামো অবকাঠামো।
এই লাইনগুলো ইউনুসের অনুসারীদের জন্য এবছরের বাংলা নববর্ষের মোনাজাত হতে পারে।